তাজীব ইসলাম ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ থেকে চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করেছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা তিনি। প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে তার জন্মসনদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এক দালালের খপ্পড়ে পড়ে বাড়তি টাকা দিয়েও দুইমাস পরে জন্মসনদ হাতে পাননি বলে অভিযোগ করেন ওই শিক্ষার্থী।
দালালের খপ্পড়ে পরে ভোগান্তির কথা সংবাদ প্রকাশ-কে জানান তাজীব ইসলাম। অভিযোগ করে তাজীব ইসলাম বলেন, "গত বছর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নিজের ও মা-বাবার জন্মসনদ নিবন্ধন করার জন্য খিলগাঁও ডিএসসিসির আঞ্চলিক অফিস-২ এর কার্যালয়ে যাই। সেখানে প্রবেশ গেটে পরিচয় হয় কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইয়াসমীন বেগমের সঙ্গে।"
"ওই সময় ইয়াসমীন বেগম জানান, অনলাইনে সার্ভার সমস্যা থাকে। জন্মসনদ পেতে অনেক সময় লাগে। তিনি দ্রুত জন্মসনদ করে দিতে পারবে। কিন্তু এরজন্য় বাড়তি কিছু টাকা দিতে হবে। পরে ইয়াসমিন বেগম জন্মসনদ প্রতি আমার থেকে তিনজনের জন্য় জনপ্রতি ৬০০ করে মোট ১৮০০ টাকা দিতে বলেন। তখনই আমি পুরো টাকা তাকে (ইয়াসমিন) দেই। কিন্তু দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও সনদ হাতে পাইনি।ইয়াসমিন ফোন দিয়ে পরে জানাবেন বলে বারবার ফিরিয়ে দেন।"
তাজীব ইসলাম জানান, বেশ কয়েকবার অফিসে এসেও জন্মসনদের বিষয়ে তিনি খবর নিয়েছেন। কিন্তু সনদ পাওয়ার বিষয়ে কোনো নিশ্চিত খবর দিতে পারেননি ডিএসসিসির আঞ্চলিক অফিসের ওই নারী কর্মী। তবে পরে তিনি অপারগতা জানিয়ে টাকা ফিরিয়ে দেন।
তাজীব ইসলামে করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইয়াসমীন বলেন, “আমি কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে কাজ করি না। অনেকে এখানে জন্মসনদ করার জন্য আসেন। যারা অনলাইনে কীভাবে টাকা জমা দিতে হয় বোঝেন না, আমি তাদের একটু সাহায্য করি। এতে আমাকে খুশি মনে কিছু টাকা পয়সা দেন। কিন্তু আমি কোনো অতিরিক্ত টাকা নেই না।”
জন্ম সনদ নিয়ে ভোগান্তির শিকার আরও এক ভুক্তভোগী ঢাকা হোম ইকোনিমক্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক রাবেয়া শামস। অভিযোগ করে রাবেয়া শামস বলেন, “আমার বড় ছেলের জন্মদনদ দ্রুত করার জন্য আমি অফিসে যাই। ইয়াসমিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমাদের জন্মসনদ দ্রুত প্রয়োজন ছিল। সে আমাদের কথা দিয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্য করে দিবে। তারপর আমার ছোট ছেলে ও তার বাবার জন্মসনদ করার জন্য তিন হাজার টাকা নেয়। এক মাস হয়ে গেছে এখনো করে দেয় নাই। আজকে কয়েকদিন ফোন দিয়ে ইয়াসমিনকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
সরাসরি আবেদন না করে কেন দালালের মাধ্যমে জন্মসনদ করাচ্ছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রাবেয়া শামস বলেন, “আমি জানতাম না সরাসরি আবেদন করলে দ্রুত নিবন্ধন সম্ভব। আগে জানলে দালালের মাধ্যমে কাজ করতাম না।”
ডিএসসিসির তথ্যমতে, চার নাগরিক সেবা যেমন ট্রেড লাইসেন্স, জন্ম নিবন্ধন, মৃত্যু নিবন্ধন ও হোল্ডিং ট্যাক্সে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেশি। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জন্মসনদ নিবন্ধনে। এরমধ্যে অনিয়ম বেশি দেখা যায়, অঞ্চল-১, ২ ও ৪ এ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা জানান, সার্ভার ডাউনসহ নানা অজুহাতে কিছু কর্মী সাধারণ মানুষের থেকে বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
ডিএসসিসি ওই কর্মকর্তা বলেন, "নাগরিক সেবার দুর্ভোগ কমাতে আমাদের সব সেবা অনলাইন মাধ্যমে করা হয়েছে। তারপরও কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও দালাল চক্র এমন উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। অসাধু লোকদের ব্যাপারে কর্পোরেশন শক্ত অবস্থানে আছে।"
এদিকে খিলগাঁও আঞ্চলিক অফিসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জন্মনিবন্ধন করতে ফি লাগে মাত্র ৫০ টাকা। কোনোরূপ ঝামেলা ছাড়া অনলাইনে ফি জমা দেওয়া যায়। পরে লাইনে দাঁড়িয়ে কাগজ জমা দিতে হয়। কাগজ জমা দেওয়ার দুই থেকে চার কর্মদিবসের মধ্যেই সনদ পাওয়া যায়।
সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে ডিএসসিসির আঞ্চলিক অফিস-২ এর খিলগাঁও অফিস সহকারী সালমা আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বাচ্চার জন্মসনদ করাতে কী কী করতে হবে জানতে চাইলে সালমা আক্তার বলেন, “সার্ভারে সমস্যা ও লাইনে দাঁড়িয়ে কাগজ জমা নিতে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়। আমি দ্রুত সময়ে করে দিব জন্মসনদ। কিন্তু টাকা লাগবে ১২০০ টাকা।"
৫০ টাকা জন্মসনদ পেতে ১২০০ টাকা কেন লাগবে, জানতে চাইলে সালমা আক্তার বলেন, "তিনজন স্যারের স্বাক্ষর লাগবে। তিনজনকেই স্বাক্ষরের জন্য় টাকা দিতে হবে। প্রশাসন শাখায় কাজ করি। বড় পরিচয় দিয়ে লাভ নেই। মানুষকে সাহায্য করি, আর দুইটা টাকা পেলেই হবে। জন্ম ও মৃত্যু সনদ, ট্রেড লাইসেন্স যার যা লাগে করে দিতে পারবো।”
মুদি দোকানের ট্রেড লাইসেন্স করার জন্য ওই কার্যালয়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য খলিলকে জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি দ্রুত ট্রেড লাইসেন্স করে দিতে পারবেন বলে জানান। এরপর খলিল অন্য একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে বলে জানান। পরে অফিস সহকারী মশিউরের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
মুদি দোকানের ট্রেড লাইসেন্স করার বিষয়ে অফিস সহকারী মশিউর বলেন, “লাইসেন্স একদিনেই করে দিব। আমাদের কাছে আজকে কাগজপত্র নিয়ে আসবেন, কালকে নিয়ে যাবেন। সরকারি ফি তিন হাজার টাকার মতো, আমাদেরকে দিতে হবে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করি। আজকেই করে দিব। লাইসেন্স ইন্সপেক্টর আমার কাছের লোক। আপনারা গেলে সময় নিবে তিন থেকে চারদিন। আর আমি আজকেই করে দিতে পারবো।”
এদিকে জন্মসনদ, ট্রেড লাইসেন্সসহ নাগরিক সেবার এমন দুর্ভোগ আগের চেয়ে অনেকটা কমেছে বলে দাবি করেন ডিএসসিসি অঞ্চল-২ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুয়ে মন জো।
ডিএসসিসি অঞ্চল-২ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুয়ে মন জো বলেন, “নাগরিক সেবা নিতে আসা সাধারণ নাগরিকের দুর্ভোগ আগের তুলনায় অনেকটা কমে গেছে। আমি এখানে দুই বছরে তিনবার অভিযান পরিচালনা করেছি। এসব অভিযানে বেশ কয়েকটি দালালকে আমি গ্রেপ্তার করে পুলিশে দিয়েছি। যারা সবাই আমার অফিসের বাইরের লোক। দালালের দৌরাত্ম্য ও দ্রুত নাগরিক সেবা পেতে আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরও বলেন, “আমার ৭২ ঘণ্টার মধ্য যেকোনো নাগরিক সেবা নিশ্চিত করে থাকি। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের কিছু সম্মানিত নাগরিক অনলাইনের আবেদন প্রক্রিয়াকে কঠিন মনে করেন এবং তারা দালাল চক্রের সাহায্য নেন। সাধারণ মানুষরা যদি কাজগুলোকে নিজেরা করার চেষ্টা করতো তাহলে দালালের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে আনার প্রক্রিয়া সহজ হয়ে যেত।”
অফিসের তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কিছু লোকরা এসব দালালি কাজে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, “যে লোকগুলোর কথা উঠে এসেছে এর আগেও তাদের বেশ কয়েকবার সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো নাগরিক লিখিত অভিযোগ করেন না। লিখিত অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।”
সাধারণ মানুষের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুয়ে মন জো বলেন, “আমার এই অফিসে আপনাদের কোনো কাজ করতে সমস্যা হলে সরাসরি লিখিত অভিযোগ করুন। প্রয়োজনে আমার কাছে চলে আসবেন। আমি সর্বাধিক সহযোগিতা করবো।”